এক রাতের বৃষ্টিতে রাজশাহীর গোদাগাড়ী ও তানোর উপজেলার বিস্তৃত এলাকায় ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। অনেকেরই কাঁচা ঘর ভেঙে পড়েছে। পুকুরের মাছ ভেসে গেছে। জমির আধপাকা ধানগাছ নুয়ে পড়েছে। জেলার অন্য উপজেলাগুলোতেও ধানসহ অন্যান্য ফসলের ক্ষতি হয়েছে। প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে, জেলার প্রায় ৮০ শতাংশ ধানগাছ মাটিতে নুয়ে পড়েছে।
ঘূর্ণিঝড় মোন্থার প্রভাবে গত শুক্রবার রাতভর রাজশাহী ও এর পাশের জেলায় ভারী বর্ষণ হয়। বৃষ্টি হয় পরদিন শনিবারও। এতে রাজশাহীর বিভিন্ন এলাকায় আকস্মিক বন্যা দেখা দেয়। রোববার বিকেলে বন্যাকবলিত এলাকায় গিয়ে দেখে যায়, এরই মধ্যে পানি অনেকটা নেমে গেছে, কিন্তু ঘরহারা মানুষদের রাস্তায় রাত কাটাতে হয়েছে।
বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ সূত্রে জানা গেছে, গোদাগাড়ীতে শুক্রবার রাতে হয়েছে ১৬২ মিলিমিটার বৃষ্টি। শনিবার সকালে হয়েছে ৭৪ মিলিমিটার। আর তানোরে শুক্রবার রাত থেকে শনিবার সকাল পর্যন্ত বৃষ্টি হয়েছে ১১৩ মিলিমিটার।
রাজশাহী কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক মো. নাসির উদ্দিন গতকাল বিকেলে প্রথম আলোকে বলেন, সব মিলিয়ে রাজশাহীতে প্রায় ৫০০ হেক্টর জমির ধান, সবজিসহ অন্যান্য ফসলের ক্ষতি হয়েছে বলে প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে। এর মধ্যে আগাম আলু ও শর্ষেও রয়েছে।
এত বৃষ্টি হবে কেউ ভাবেনি
গোদাগাড়ীর কালোসাঁকো বিলে চারটি পুকুর ছিল মারিফুল ইসলামের। তিনি বলেন, ‘বৃষ্টি যে এত হবে, তা বুঝতে পারিনি। সকালে এসে দেখি পুকুর ভেসে গেছে। আমার সব পুকুরে প্রায় চার লাখ টাকার মাছ ছিল।’
গোদাগাড়ীর রিশিকুল ইউনিয়নের খড়িয়াকান্দি এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, দুটি স্থানে পাকা রাস্তা প্লাবিত হয়ে এক পাশ থেকে আরেক পাশে পানি যাচ্ছে। স্থানীয় লোকজন সেখানে জাল দিয়ে মাছ ধরছেন। রাস্তার দুই পাশে বিলের শত শত বিঘা জমির ধান প্লাবিত হয়ে গেছে। খড়িয়াকান্দি খালের পাশে ১০-১২টি বাড়ি ছিল। বাড়িগুলোর মাটির দেয়াল ভেঙে পড়েছে।
মান্ডইল নলপুকুর গ্রামের বিশ্বনাথ সরেনের দুটি ঘর ধসে পড়েছে। তিনি বললেন, ‘এত বৃষ্টি হবে ভাবিনি। ঘুমিয়ে পড়েছি। মাঝরাতে ঘুম ভাঙছে দেয়াল ধসে পড়ার শব্দে। কপাল ভালো ঘর দুটিতে কেউ ছিল না।’
কাঁকনহাট, আলোকছত্র হয়ে তানোর উপজেলার সরনজাই ও কালীগঞ্জ এলাকা ঘুরে দেখা যায়, মাঠের পর মাঠ ধানগাছ নুয়ে পড়েছে।
গোদাগাড়ী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) ফয়সাল আহমেদ বলেন, উপজেলার ৪৬৩ পরিবার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। শুধু রিশিকুল ইউনিয়নের ৭১টি কাঁচা ঘর ভেঙে পড়েছে। পাকড়ি ইউনিয়নে আরও ১০–১৫টি ঘর ভেঙে পড়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত খড়িয়াবাড়ি গ্রামের কিছু স্বেচ্ছাসেবক খাবার রান্না করে বিতরণ করেছেন।
‘বাড়িঘর, জমির ধান একসাথেই হারানু’
গোদাগাড়ীর পাকড়ি ইউনিয়নের বিল্লি গ্রামের সেলিম আলীর (৪১) বাড়ি ভেঙে মাটিতে মিশে গেছে। তিনি বলেন, ৪০ বছর আগে তাঁর বাবা এই বাড়ি বানিয়েছিলেন। এই দোতলা বাড়ির চারটা কক্ষ ছিল। শুধু ফ্রিজটা বের করতে পেরেছেন, আর সব মাটির নিচে চাপা পড়েছে।
প্রসাদপাড়া গ্রামের মো. মোস্তাকিন আলীর বিলে প্রায় সাত বিঘা জমির আধা পাকা ধান তলিয়ে গিয়েছিল। তাঁর ছয় বিঘার পুকুরের মাছ ভেসে গেছে। গতকাল বিকেলে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, পানি নেমে গিয়ে ধান কিছুটা জেগেছে। পুকুরের একটি মাছও পাবেন না। আলুতে তিনি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন।
গ্রামের মুকুল আলীর বাড়িও ভেঙে পড়েছে। দেড় বিঘা জমির ধানও ডুবে গেছে। তিনি বলেন, ‘এখন কী কহরবো বুঝতে পাইচ্ছি না। বাড়িঘর জমির ধান একসাথেই হারানু।’
জেলা মৎস্য কর্মকর্তা জাহাঙ্গীর আলম বলেন, জেলায় মাছে ক্ষতির পরিমাণ এখনো হাতে পাননি। তবে তিনি বলেন, পুকুর ভেসে যাওয়ার কথা তিনি শুনেছেন। অপরিকল্পিত পুকুর খননের কারণে এমনটা হয়েছে বলে তিনি মন্তব্য করেন।
ঘরের ভেতর পানির স্রোত
তানোর উপজেলা সদরে অবস্থিত আব্দুল করিম সরকারি কলেজের ছাত্রাবাস মাটির তৈরি। শুক্রবার রাতে ছাত্রাবাসে শিক্ষার্থীরা ঘুমিয়ে ছিলেন। রাত দুইটার দিকে ছাত্রাবাস ভেঙে পড়ার আশঙ্কায় ছাত্রদের সরিয়ে নেওয়া হয়। ভোরের দিকে উত্তর পাশের একটি দেয়াল ভেঙে পড়ে।
তানোরের বনকিশোর ব্রিজঘাট এলাকার বাসিন্দা আজহার ইসলাম জানান, তাঁর বাড়িটি মাটির। রাতে হঠাৎ শব্দ পেয়ে জেগে উঠে দেখেন, ঘরের ভেতর দিয়ে পানির স্রোত যাচ্ছে। ভোরের দিকে ঘর ভেঙে পড়ে।
উপজেলার পাঁচন্দর ইউনিয়ন, সরঞ্জাই ইউনিয়নের তাঁতিহাট ও তানোর পৌর এলাকার চাপড়া গ্রামে ফসলের সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে।
তানোর গোদাগাড়ী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা নাঈমা খান বলেন, ইউনিয়ন পরিষদ থেকে তালিকা করা হচ্ছে। তালিকা পেলেই তাঁরা সেই অনুযায়ী ব্যবস্থা নেবেন।
অতিবৃষ্টি হয়েছে উল্লেখ করে জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা মো. আব্দুল হাই সরকার প্রথম আলোকে বলেন, ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের তালিকা করা হচ্ছে। সোমবার (আজ) থেকে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের মধ্যে ঢেউটিন ও খাদ্যসামগ্রী বিতরণ করার প্রস্তুতি চলছে।
