রাজশাহীর আরডিএ মার্কেটের মসজিদের নিচে ছিল প্রায় ৪৯ বছরের পুরোনো গেঞ্জির দোকান ‘বাবুল স্টোর’। বীর মুক্তিযোদ্ধা গোলাম রসুল ওরফে বাবুলের মালিকানার দোকানটি গত ১ অক্টোবর বন্ধ হয়ে গেছে।
বাবুল জানান, আগে দোকানটিতে গেঞ্জি, মোজা পাইকারি বিক্রি করতেন, পরে খুচরা শুরু করেন। এখন ফুটপাতেই এসবের কাঁড়ি কাঁড়ি দোকান গজিয়েছে। ফলে ফুটপাত মাড়িয়ে মানুষ আর দোকানে ঢুকতে চান না। তাই বাধ্য হয়ে ব্যবসা বন্ধ করে দোকানটি ভাড়া দিয়েছেন।
রাজশাহীর অসংখ্য ব্যবসায়ীই এখন একই সমস্যায় পড়েছেন। ফুটপাতের দোকানদারদের ভাড়া, ভ্যাট বা ট্যাক্স কিছুই দিতে হয় না। ফলে মূল ব্যবসায়ীরা বড় বিনিয়োগ করেও টিকতে পারছেন না।
রাজশাহী নগরের মূল ব্যবসাকেন্দ্র বলা হয় সাহেব বাজার এলাকাটিকে। সম্প্রতি দেখা যায়, এ বাজারের দুই পাশের ফুটপাতের সঙ্গে ব্যবসায়ীরা এখন রাস্তাও দখল করেছেন।
স্থানীয় বাসিন্দাদের দাবি, এসব দোকানের কারণে চলাচলের রাস্তাটি সরু হয়ে পড়েছে। এতে সেখানে দিনরাত যানজট লেগে থাকছে। পথচারীরা ফুটপাত ব্যবহারের কোনো সুযোগ পান না বললেই চলে। ফুল-ফল, তালা–চাবি, লুঙ্গি, গামছা থেকে শুরু করে—এমন কোনো জিনিস নেই, যা এসব ফুটপাতের ব্যবসায়ীর কাছে পাওয়া যায় না।
বেদখল রাজশাহী মেডিকেলের সামনের ফুটপাত
সাহেব বাজারের মতো রাজশাহী মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের সামনের ফুটপাত দিয়েও হাঁটার মতো পরিস্থিতি নেই। হাসপাতালের সামনের ফুটপাত দখল হয়ে গেছে দোকান আর হোটেলে। দক্ষিণ পাশে অন্তত নয়টি ভাতের হোটেল দিনরাত খোলা থাকে। রাস্তাতেই রুটি সেঁকা হয়। উত্তর পাশেও দোকানপাট নেমে এসেছে সড়কে।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের দাবি, অভিযান চালিয়ে ফুটপাত খালি করা হলেও পরদিনই আবার দোকান বসে যায়। ফলে সেখানে পথচারীদের হাঁটার জায়গা নেই, আর যানজটে রোগী আনা-নেওয়াও হয়ে উঠেছে কষ্টসাধ্য।
এভাবে রাস্তা-ফুটপাতের ওপর দোকান বসানোর জন্য কাউকে কোনো ভাড়া বা চাঁদা দিতে হয় কি না, তা জানতে চাওয়া হয় দক্ষিণ পাশের এক ভাতের হোটেলের মালিকের কাছে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে তিনি বলেন, এই দোকান চালানোর জন্য কাউকে কোনো পয়সা দিতে হয় না। কেউ কেউ নিজেই জায়গার দখল নিয়েছেন। কেউ আবার দোকান চালাচ্ছেন আরেকজনের দখল করা জায়গার ওপর।

এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয় রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এফ এম শামীম আহাম্মদের। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, এই সমস্যার জন্য বিভাগীয় কমিশনার, জেলা প্রশাসক, র্যাব ও স্থানীয় ক্যান্টনমেন্টের জিওসিকেও তিনি চিঠি লিখেছেন, টেলিফোনে জেলা প্রশাসকের সঙ্গে এবং হাসপাতালে পেয়ে বিভাগীয় কমিশনারকে সামনাসামনি জানিয়েছেন। এখন তাঁদের কার্যক্রম দেখার অপেক্ষায় আছেন।
শামীম আহাম্মদ বলেন, হাসপাতালের নিরাপত্তায় মাত্র ১০ জন পুলিশ ও ৪০ জন আনসার সদস্য আছেন। তাঁরা পালাক্রমে দায়িত্ব পালন করেন। এখন সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ সহযোগিতা না করলে তিনি একা বাইরের পরিবেশ ঠিক করতে পারবেন না।
‘কাউকে কোনো টাকাপয়সা দিতে হয় না’
নগরের সাহেব বাজার বড় মসজিদ চত্বরে চপ, শিঙাড়া, পেঁয়াজু, ডালপুরিসহ বিভিন্ন ধরনের ভাজাপোড়া বিক্রি হয়। দোকানের ওপর পলিথিন দিয়ে বড় করে চালা তৈরি করা হয়েছে। পাশেই কড়াইয়ে ভাজা হচ্ছে খাবার। দোকানের মালিক উজ্জ্বল হোসেন ১০ থেকে ১২ বছর ‘ফল ভান্ডার’ নামে দোকান চালাতেন। বছরখানেক থেকে ভাজাপোড়ার দোকান করেছেন। তিনি দোকানে ছিলেন না। কাজ করছিলেন চার কর্মচারী। রয়েজ মিয়া নামের এক কর্মচারী বলেন, ‘এই চত্বরে ব্যবসার জন্য কাউকে কোনো টাকাপয়সা দিতে হয় না।’
এই প্রতিবেদকের সঙ্গে রয়েজকে কথা বলতে দেখে এগিয়ে আসেন নাহিদ হোসেন নামের এক ফলের দোকানি। তিনি নিজেকে ফুটপাত ব্যবসায়ীদের সভাপতি পরিচয় দিয়ে বলেন, সেখানে মোট ৪১টি দোকান আছে। এখানে তাঁদের কাছে কেউ পয়সা চাইতে পারেন না।
সাহেব বাজারে রাস্তার দক্ষিণ পাশে প্রায় অর্ধশত কাপড়ের দোকান আছে। তাঁরা ফুটপাত থেকে নেমে রাস্তার ওপর চলে এসেছেন। লুঙ্গি-গামছার বড় দোকান নিয়ে রাস্তার ওপরে বসেন মো. বাদশা। তাঁর ভাষ্য, প্রায় ১৫ বছর ধরে এই ব্যবসা করছেন, তাঁর বাবা ৩৪ বছর করেছেন। তাঁকে কোনো অর্থ দিতে হয় না। অন্য কাউকে দিতে হয় কি না, তা তিনি বলতে পারবেন না।
নগরের গণকপাড়ার মোড়ে প্রশস্ত রাস্তা দখল করে জামাকাপড়ের দোকান বসানো হয়েছে। মোড়টিতে আফতাব হোসেন নামের এক বিক্রেতা ছোট বাচ্চাদের পোশাকের দোকান সাজিয়েছেন। তিনি বলছেন, প্রায় ২০ বছর ধরে তিনি ফুটপাতে ব্যবসা করছেন। এক জায়গা থেকে তুলে দেয়, আরেক জায়গায় যান। এখন এই মোড়ে ভ্যানের ওপরে দোকান করছেন। কাউকে কোনো পয়সা দিতে হয় না।

‘অব্যবস্থাপনার দায় সিটি করপোরেশন ও পুলিশ প্রশাসনের’
রাজশাহী নগরের বিভিন্ন স্থানে রাস্তা-ফুটপাত দখল করে এভাবে ব্যবসার কারণে নিজেরা ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন বলে দাবি করেছেন ব্যবসায়ীনেতারা। তাঁরা এ বিষয়ে সংশ্লিষ্টদের কার্যকর উদ্যোগ নেওয়ার তাগিদ দিয়েছেন।
রাজশাহী ব্যবসায়ী সমন্বয় পরিষদের সাধারণ সম্পাদক মো. সেকেন্দার আলী আক্ষেপ প্রকাশ করে বলেন, তাঁরা সাত থেকে আট রকমের ভ্যাট-ট্যাক্স দিয়ে ব্যবসা করেন। ২০ থেকে ২৫ লাখ টাকা দিয়ে পজিশন কেনেন, মাসে ২০ থেকে ৩০ হাজার টাকা ভাড়া গুনছেন। এখন তাঁদের ব্যবসাই চলছে না। সব ধরনের মালামাল নিয়ে ফুটপাতের বসে গেছেন লোকজন। গত ১৫ বছরে অন্তত ২০ জন ব্যবসায়ী নিজেদের প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দোকান ভাড়া দিয়েছেন বা অন্য কোনো মালামাল তুলেছেন। ফুটপাতের ব্যবসায়ীদের কিছু বলা যায় না; বললেই রাজনৈতিক প্রভাব দেখান। এ ছাড়া তাঁদের সিন্ডিকেট আছে। তাঁরা নিজেরা টাকা তোলেন, কিন্তু সেই টাকা কোথায় যে যায়, তা বোঝা যায় না। এই অব্যবস্থাপনার দায় সিটি করপোরেশন ও পুলিশ প্রশাসনের। তারা এসব দেখেও কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নেয় না।
ফুটপাতের ব্যবসায়ীরা আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল নন। তাঁদের উচ্ছেদের জন্য সিটি করপোরেশনের অভিযান চলছে। এ অভিযান অব্যাহত থাকবে।
নিজেদের সীমাবদ্ধতার কথা স্বীকার করে রাজশাহী মহানগর পুলিশ কমিশনার আবু সুফিয়ান প্রথম আলোকে বলেন, হকারদের একদিক থেকে তুলে দিলে আরেক দিকে গিয়ে বসে। এখন গ্রাম থেকেও প্রচুর হকার ফুটপাতে বসে যাচ্ছেন। বিশেষ করে সাহেব বাজারে তাঁরা একটা তালিকা করে দিয়েছিলেন, যাতে এর বাইরে কেউ না বসতে পারেন। এ নিয়ে বিশ্ব বসতি দিবসের অনুষ্ঠানে তাঁরা সিটি করপোরেশনের সঙ্গে আলোচনা করেছেন। এগুলো সিটি করপোরেশনেরই দেখা দরকার। ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণে কোনো সমস্যা হলে পুলিশ দেখবে।
রাজশাহী সিটি করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মো. রেজাউল করিম বলেন, ফুটপাতের ব্যবসায়ীরা আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল নন। তাঁদের উচ্ছেদের জন্য সিটি করপোরেশনের অভিযান চলছে। এ অভিযান অব্যাহত থাকবে।
