নদ-নদী, খাল-বিল ও জলাশয়গুলোতে দেশের ঐতিহ্যবাহী মাছ ও জলজ জীববৈচিত্র্য রক্ষার জন্য বিধিমালা আছে। তা সত্ত্বেও বরেন্দ্র অঞ্চলে আজকের বাস্তবতা একেবারে ভিন্ন। সেখানে ‘চায়না দুয়ারি’ নামে পরিচিত ছোট ফাঁসযুক্ত একধরনের জালের অবাধ ও নিয়মবিরোধী ব্যবহার নদ-নদী ও খাল-বিলের বাস্তুসংস্থানকে হুমকির মুখে ফেলেছে। সরকারি কর্তৃপক্ষের উদাসীনতা এ সংকটকে আরও জটিল ও সুদূরপ্রসারী করে তুলেছে।
বরেন্দ্র অঞ্চলের জেলেদের পর্যবেক্ষণভিত্তিক গবেষণায় দেখা যাচ্ছে, এই জাল দিয়ে মাছের পোনাসহ সব প্রজাতির দেশীয় মাছ নির্বিচার নিধন হচ্ছে। এটি একধরনের ‘নির্বিচার হত্যাযজ্ঞ’। এটি শুধু খাদ্যনিরাপত্তা বিপন্ন করছে না, এটি বরং জলজ উদ্ভিদ, পাখি, ব্যাঙ, কচ্ছপসহ সম্পূর্ণ জলজ বাস্তুসংস্থানকে ভয়ংকর হুমকিতে ফেলে দিয়েছে।
প্রাতিষ্ঠানিক বিধি অনুযায়ী, সাড়ে চার সেন্টিমিটারের কম আয়তনের ফাঁসের জাল নিষিদ্ধ হলেও মাঠপর্যায়ে এই বিধির কোনো কার্যকর প্রয়োগ নেই। এই ব্যবস্থাপনার অভাবই ‘চায়না দুয়ারি’ জালের ক্রমবর্ধমান ব্যবহারকে উৎসাহিত করছে।
পরিবেশ ও বাস্তুতন্ত্রের ওপর এই জালের ক্ষতিকর প্রভাব গভীর। ক্ষুদ্র ফাঁসের কারণে পোনা মাছ নিধন হয়। এতে মাছের প্রজনন হ্রাস পায়। দীর্ঘ মেয়াদে নদ-নদীর মাছের প্রজাতিগত বৈচিত্র্য বিলুপ্তির পথে চলে। পাশাপাশি জলজ উদ্ভিদ ও অন্যান্য প্রাণী, যেমন ব্যাঙ, কচ্ছপ এবং জলজ পাখির প্রজনন চক্র বিঘ্নিত হয়।
এটি শুধু প্রাকৃতিক ভারসাম্যের ক্ষতি করছে না, বরং স্থানীয় জেলেদের জীবিকা ও খাদ্য সুরক্ষার ওপরও বিধ্বংসী প্রভাব ফেলছে।
তাঁদের দাবিগুলো সংগতিপূর্ণ ও অত্যন্ত যৌক্তিক। কারণ, সমস্যার সমাধান একমাত্র কার্যকর সমাধান নীতিনির্ধারণ ও কঠোর নিয়ন্ত্রণে নিহিত। সে কারণে প্রাথমিকভাবে চায়না দুয়ারি জালের আমদানি, উৎপাদন ও বিক্রয় সম্পূর্ণভাবে নিষিদ্ধ করতে হবে। সংশ্লিষ্ট কারখানা ও উৎপাদন কেন্দ্রও বন্ধ করতে হবে। এ ছাড়া মাঠপর্যায়ে আইন প্রয়োগ নিশ্চিত করতে স্থানীয় প্রশাসন ও মৎস্য কর্মকর্তাদের দায়িত্ববোধ জাগ্রত করতে হবে।
মনে রাখা দরকার, জলজ বাস্তুসংস্থান রক্ষা শুধু পরিবেশ সংরক্ষণ নয়, এটি জাতীয় খাদ্যনিরাপত্তা, জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ ও স্থানীয় অর্থনীতির অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। চায়না দুয়ারির অবাধ ব্যবহার বন্ধ করা হলে বরেন্দ্র অঞ্চলের নদ-নদী পুনরায় প্রাণবন্ত হবে, দেশীয় মাছের প্রজনন স্বাভাবিক হবে ও স্থানীয় জেলেদের জীবনমান উন্নত হবে। ফলে এই সংকট থেকে উত্তরণের পথ সুস্পষ্ট: প্রশাসনিক কার্যকারিতা, আইন প্রয়োগ ও নাগরিক অংশগ্রহণের সমন্বয়।
