মোগল সম্রাট আকবরের মুদ্রা, ৩০০ বছরের পুরোনো পুঁথি, বিলুপ্ত মুঠোফোন কোম্পানির সিম কার্ড, এমন সবকালের সাক্ষী হয়ে থাকা নিদর্শন দেখার সুযোগ মিলল রাজশাহীতে। ব্যক্তিগত শখ ও ভালোবাসায় সংগ্রাহকদের গড়ে তোলা এই ভান্ডার মুগ্ধ করেছে দর্শনার্থীদের। ‘বরেন্দ্র ঐতিহ্য প্রদর্শনী’ নামের এই আয়োজন শেষ হয়েছে আজ শনিবার।
রাজশাহী নগরের শালবাগান এলাকায় রাজশাহী শিক্ষা বোর্ড মডেল স্কুল অ্যান্ড কলেজে দুই দিনব্যাপী এই প্রদর্শনীর আয়োজন করে ‘বরেন্দ্র পরিবেশ উন্নয়ন স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা’। গতকাল শুক্রবার শুরু হওয়া এই প্রদর্শনীতে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ১৪ জন সংগ্রাহক তাঁদের অমূল্য সব নিদর্শন নিয়ে হাজির হন।
প্রথম দিন প্রদর্শনীতে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন রাজশাহী বরেন্দ্র গবেষণা জাদুঘরের পরিচালক কাজী মো. মোস্তাফিজুর রহমান। বিশেষ অতিথি ছিলেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব বিজনেস অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের পরিচালক শরিফুল ইসলাম, রাজশাহী শিক্ষা বোর্ড মডেল স্কুল অ্যান্ড কলেজের অধ্যক্ষ মো. মোয়াজ্জেম হোসেন, রাজশাহী স্বার্থ সংরক্ষণ কমিটির সভাপতি এনামুল হক। এই অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন প্রকৌশলী মো. জাকির হোসেন।
প্রদর্শনীতে কথা হয় পেশায় চিকিৎসক মো. ফরহাদুর রহমানের সঙ্গে। প্রায় ২০ বছর ধরে মুদ্রা সংগ্রহ করছেন তিনি। বাবার বই সংগ্রহের অভ্যাস দেখে অনুপ্রাণিত হলেও তাঁর আগ্রহ জন্মে মুদ্রার প্রতি। তিনি বলেন, ‘ছোটবেলা থেকেই সংগ্রহের শখ। প্রথমে ব্রিটিশ ও পাকিস্তান আমলের তামার মুদ্রা দিয়ে শুরু করি। মেডিকেলে পড়ার সময় রুপার মুদ্রার প্রতি মনোযোগ দিই।’
স্বর্ণকার বা বিভিন্ন ডিলারের কাছ থেকে এসব মুদ্রা সংগ্রহ করেন বলে জানান ফরহাদুর। তাঁর সংগ্রহে মোগল সম্রাজ্ঞী নূরজাহান, সম্রাট আকবর, বাংলার স্বাধীন সুলতানি আমল ও সুরি সাম্রাজ্যের মুদ্রার এক বিশাল সম্ভার রয়েছে।
প্রজন্মের সঙ্গে বদলে যায় সংগ্রহের ধরনও। সংগ্রাহক মতিউর রহমান দেখালেন তাঁর ভিন্নধর্মী সংগ্রহ—পুরোনো দিনের কমিকস, উদ্বোধনী খাম, বিলুপ্ত হয়ে যাওয়া ম্যাচবক্স এবং গ্রামীণফোন, ওয়ারিদ ও বাংলালিংকের প্রথম দিককার সিম কার্ডের প্যাকেট। তাঁর মতে, আজকের দিনের সাধারণ জিনিসও আগামী প্রজন্মের কাছে ইতিহাসের অংশ হয়ে উঠবে।
প্রকৌশলী তানভীর মতির সংগ্রহে থাকা ৩০০ বছরের পুরোনো তুলট পাতায় লেখা পুঁথিটি ছিল প্রদর্শনীর অন্যতম আকর্ষণ। আরেক সংগ্রাহক আবু বকর সিদ্দিক প্রায় ১৬ বছর ধরে মহাস্থানগড়, সাপাহারসহ বরেন্দ্র অঞ্চলের বিভিন্ন এলাকা থেকে প্রাচীন মাটির তৈজসপত্র ও কষ্টিপাথর সংগ্রহ করছেন। তিনি বলেন, ‘বিভিন্ন জায়গায় ঘুরতে গিয়ে দেখতাম, পুরোনো তৈজসপত্র বা খেলনা বাচ্চারা ভেঙে ফেলছে। ইতিহাসকে বাঁচিয়ে রাখার আগ্রহ থেকেই এগুলো সংগ্রহ করা শুরু করি।’
এই সংগ্রাহকেরা নিজেদের অর্থ ও শ্রমে দেশের আনাচকানাচে ঘুরে ইতিহাসের নিদর্শন সংগ্রহ করেন। তাঁদের এই ব্যক্তিগত উদ্যোগ শুধু শখ পূরণই নয়, দেশের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিকে প্রজন্মের পর প্রজন্ম টিকিয়ে রাখার এক অনন্য প্রচেষ্টা বলে মনে করছেন দর্শনার্থীরা।
প্রদর্শনী দেখতে আসা রোকেয়া ইসলাম বলেন, ‘একটি মুদ্রা মানে ওই সময়ের ইতিহাসের একটি অংশ। এখানে অনেক পুরোনো মুদ্রা রয়েছে, যা সেই সময়ের ইতিহাসকে মনে করিয়ে দেয়। পুরোনো কমিকস বই দেখে নিজের ছেলেবেলায় ফিরে গিয়েছিলাম। প্রদর্শনীটি দেখে আমারও সংগ্রহের আগ্রহ জেগেছে।’
আয়োজক বরেন্দ্র পরিবেশ উন্নয়ন স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার সভাপতি প্রকৌশলী মো. জাকির হোসেন বলেন, এই প্রদর্শনীর উদ্দেশ্য ছিল মুদ্রা ও ডাকটিকিটের মাধ্যমে শিশুদের ইতিহাস সম্পর্কে ধারণা দেওয়া এবং তাদের সংগ্রহে আগ্রহী করে তোলা। তারা এ বিষয়ে আগ্রহী হলে মাদক বা মুঠোফোন আসক্তি থেকে দূরে থাকবে।
প্রদর্শনীতে শিশুদের জন্য চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতা, চিত্রকর্ম প্রদর্শন, জাদু প্রদর্শনীসহ নানা আয়োজন ছিল। শনিবার বিকেলে পুরস্কার বিতরণীর মাধ্যমে এই আয়োজন শেষ হয়।
